রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধ: বাংলাদেশের ওপর প্রভাব এবং বাংলাদেশের অবস্থান

রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধ: বাংলাদেশের ওপর প্রভাব এবং বাংলাদেশের অবস্থান

রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধ: বাংলাদেশের ওপর প্রভাব এবং বাংলাদেশের অবস্থান

মোহাম্মদ হুমায়ূন কবীর

বর্তমান অস্থিতিশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে গত এক বছরের বেশি সময়ব্যাপী চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তীব্রতা ক্রমে বেড়ে চলছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ এ ইউক্রেনের শহরগুলোতে কয়েক ডজন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হয়েছিল। এই আক্রমণটিকে আন্তর্জাতিকভাবে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটের সূত্রপাত করে, প্রায় ৮৮ লক্ষেরও বেশি ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়েছে এবং আরও লক্ষাধিক অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়। ১৯৪৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইউরোপে যত সংঘাত হয়েছে, তার মধ্যে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ সবচেয়ে বিধ্বংসী সংঘাত। পশ্চিমের অনেকেই যখন এ যুদ্ধকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের চাপিয়ে দেওয়া এক যুদ্ধ হিসেবে দেখছেন, তখন পুতিন বলেছেন, ন্যাটো ২০০৮ সালে ইউক্রেনকে তাদের জোটের সদস্যভুক্ত করার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটি রাশিয়ার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিল; সে কারণে রাশিয়া এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। অর্থাৎ ন্যাটো জোটের পূর্বমুখী সম্প্রসারণের ফলে রাশিয়া ইউক্রেন আগ্রাসনের একটি ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। অন্যদিকে, ইউক্রেন আক্রমণের শিকার হওয়ায় পাল্টা আক্রমণ করেছে। ন্যাটো, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া আর্থিক, সামরিক এবং মানবিক সহায়তার সাথে যুক্তরাজ্যসহ তার মিত্রদের সমর্থনে ইউক্রেন গত এক বছর ধরে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। যুদ্ধের শুরু থেকেই পশ্চিমা দেশগুলো একত্রিত হয়ে ইউক্রেনকে নতুন নতুন অস্ত্র সরবরাহ করেছে, তার বিপরীতে রাশিয়াও নিজেদের শক্তিশালী অস্ত্রগুলোর ব্যবহার শুরু করেছে। পশ্চিমা বিশ্ব ও যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সমর্থন করতে গিয়ে পরোক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে এবং এই সংকটকে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। উভয় দেশ নিজেদের আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ইতিহাসের পাতায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধটি একটি উভমুখী আগ্রাসন এবং উভয় দেশের আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ হিসেবে এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

মে, ২০২১ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ভিয়েতনামের পর এটাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গ্লানিময় ও বিশৃঙ্খল সেনা প্রত্যাহার। আগস্ট, ২০২১ এর মধ্যে তড়িঘড়ি প্রত্যাহারের নেপথ্যে যে ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়টিও ছিল, পরবর্তী সময়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের বক্তব্যে সেই ইঙ্গিত মেলে।

আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অক্টোবর ২০২১ এ ইউরোপে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ফাঁকে জেলেনস্কিকে সম্ভাব্য রুশ হামলার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নের বিষয়টি অবহিত করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। (সূত্র: প্রথম আলো- ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)রুশ হামলা ‍শুরুর পর ইউক্রেনের জন্য বৈশ্বিক সমর্থন আদায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কিয়েভকে সমর্থন দিতে দ্রুততার সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক জোট গড়ে তোলে ওয়াশিংটন। বেশ কয়েকটি দেশের দেওয়া সহায়তারও সমন্বয় করছে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধের এক বছরে ইউক্রেনকে ৫ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সহায়তার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অস্টিন লয়েড তথ্য দিয়েছেন, এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই দিয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার। মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তানে থাকলে ইউক্রেনকে এভাবে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হতো না।

এই যুদ্ধের ফলে ইউক্রেনের অবকাঠামো দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে আর অপরিসীম দুঃখ কষ্টে সাধারণ মানুষ বাস্তুচ্যুত ও উদ্বাস্তু জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। সারাবিশ্ব এবং জাতিসংঘ এই হামলার নিন্দা করেছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয় যেখানে সম্পূর্ণভাবে হামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত রাশিয়াকে সামরিক অভিযান স্থগিত করার নির্দেশ দেয় এবং ইউরোপীয় কাউন্সিল রাশিয়াকে বহিষ্কার করে। অনেক রাষ্ট্র রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা রাশিয়া ও বিশ্বের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে এবং ইউক্রেনকে মানবিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে। এ বছর যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হওয়ায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ গত ২ মার্চ, ২০২৩ ভোট আহ্বান করে রাশিয়াকে যুদ্ধ বন্ধ করার এবং তার সমস্ত সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানায়; আলজেরিয়া, বাংলাদেশ, চীন, ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকা সহ ৩৫টি দেশ এই ভোট দানে বিরত ছিল। দুঃখজনক হলো, এক বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও এই যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ অবসান করতে জাতিসংঘ এবং বিশ্বনেতারা কোনো ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

বাংলাদেশের উপর প্রভাব:

বিবিসির একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের ৫ টি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রথমত, গম আমদানিতে বাংলাদেশ রাশিয়ার উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হওয়ায় দেশে গম এবং সকল বেকারি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। বাংলাদেশ মোট গম আমদানির ৮০ ভাগ রাশিয়া থেকে আমদানি করে। যুদ্ধের কারণে এই আমদানি ব্যাহত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ভোজ্য তেলের দাম বর্তমানে লাগামছাড়া। এর পেছনেও রয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বাংলাদেশ মূলত পাম তেল ও সয়াবিন তেল থেকেই ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটায়। এসব তেলের মূল যোগান আসতো রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। যুদ্ধের কারণে এই সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় ঝামেলা বেড়েছে। তৃতীয়ত, পোল্ট্রি ফিডের কাঁচামাল ভূট্টার মূল যোগান আসতো ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। বাংলাদেশ মোট পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনের ৬০ ভাগ কাঁচামাল আমদানি করে। আমদানি ব্যাহত হওয়ায় উৎপাদন কমেছে। এর প্রভাবে মুরগি, ডিম ও মাংসের দাম বেড়েছে। চতুর্থত, কৃষিখাতেও খরচ বেড়েছে। বাংলাদেশ রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে সিংহভাগ সার আমদানি করে। রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থাকায় মুদ্রা লেনদেন ব্যবস্থায় সমস্যার সৃষ্টি হয়, এটি বাংলাদেশকে প্রভাবিত করেছে। পঞ্চমত, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক জ্বালানি সাপ্লাই চেইনকে ওলটপালট করে দিয়েছে। নিজ প্রয়োজনে রাশিয়া কিছু দেশের কাছে কম দামে জ্বালানি বিক্রি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের তেল প্রধান দেশগুলোর জ্বালানি দাম বাড়িয়ে দেয়া, পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে, বাংলাদেশকে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।

এই যুদ্ধের ফলে আগ্রাসী শক্তিগুলো লাভবান হচ্ছে, অস্ত্রের ব্যবহার ও উৎপাদন বাড়ছে, মানুষ গৃহহীন ও উদ্বাস্তু হচ্ছে, খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির করাল গ্রাসে পড়ছে মানুষ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়ছে অথবা থেমে যাচ্ছে, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তাদের ঋণের হাত বাড়িয়ে সামনের সারিতে চলে এসেছে। নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার জটিল ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অনেকগুলো ক্ষেত্রে সরবরাহ শৃংখল বিঘ্নিত হয়েছে। মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, জাতীয় ঋণের মাত্রা বাড়ছে এবং অনেক দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি মুদ্রাসংক্রান্ত কঠোর আর্থিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।

এই যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন গুরুতর ক্ষতি। কোভিড মহামারির প্রাকৃতিক সংকট কাটিয়ে বিশ্ব যখন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার এবং ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সেটিকে আরো বাধাগ্রস্ত করে তুলেছে। যার কঠিন প্রভাব পড়ে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের অর্থনীতির উপর। এই চলমান সংকট পোশাক শিল্পে উদ্বেগের সঞ্চার করেছে। বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির জন্য একটি সম্ভাবনাময় এবং উদীয়মান বাজার রাশিয়ার উপর বেশ কয়েকটি দেশ ব্যাপক পরিধিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিশেষ করে রাশিয়াকে সুইফট আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম থেকে বাদ দিয়ে তাদের রিজার্ভের ৪৫ শতাংশ, প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার আটকে দেওয়া বাণিজ্যের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। (সূত্র: প্রথম আলো – ১৩ মার্চ, ২০২২) বাল্টিক অঞ্চলের যে সমুদ্রপথ ধরে রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশি পণ্যগুলো এতদিন রপ্তানি হচ্ছিল, সেসব এলাকাতেও ছড়িয়েছে যুদ্ধের উত্তেজনা। ফলে সেসব এলাকার চলমান রপ্তানি আদেশ এবং ভবিষ্যতের ক্রয়াদেশ নিয়ে নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এই যুদ্ধ যে কেবল বাজার অস্থিতিশীল করছে তা নয়, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবহন ভাড়া বেড়ে গেছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে আমদানি-রপ্তানি খাতের ওপর।

রাশিয়ার উপর বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়েছে বিশ্ববাজারে। মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম লাগাম ছাড়া হয়ে যায়। বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সবশেষ ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট প্রস্তাবনার শুরুতেই এই যুদ্ধ পরিস্থিতিকে গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। ‌খাদ্যপণ্যের জোগান নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে। এটি আর্থিক রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং মুদ্রাবাজারে প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশসহ বিশ্ববাজারে গম রপ্তানির বড় অংশীদার রাশিয়া ও ইউক্রেন। রাশিয়া থেকে গম আমদানিতে অসুবিধা হলে বাংলাদেশকে বিকল্প বাজার খুঁজে বের করতে হবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ খুব বেশি গম আমদানি না করলেও বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতির কারণে সরবরাহে প্রভাব পড়বে, ফলে বিকল্প দেশের সন্ধানও সুবিধাজনক হবে না।

এই যুদ্ধের কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ সহ যেসব প্রকল্পে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, সেগুলো দীর্ঘসূত্রিতার কবলে পড়ে যাচ্ছে। এই যুদ্ধের ফলে ইউরোপজুড়ে উদ্বাস্তু সংকট তৈরি হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা এবং পুনর্বাসন উদ্যোগ মন্থর হয়ে পড়ছে। এ বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে বলা যায়, যুদ্ধটি যদিও ইউরোপ মহাদেশে, কিন্তু পরিণতি এবং ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায় এটি বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কেননা এতে পৃথিবীর সবকটি মহাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বাংলাদেশের অবস্থান: ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর বাংলাদেশ সতর্ক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে৷ দুই পক্ষই যেন সংযত থাকে এবং যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তৎপর হয়, এমনটিই বাংলাদেশের অবস্থান। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ – বঙ্গবন্ধুর দেখানো পররাষ্ট্রনীতিতেই চলছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সবসময় সব ধরনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে৷ একটি শান্তিকামী দেশ হিসেবে সব রকম যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সংকট বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী৷ বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান এবং রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা, তাতে নীতিগতভাবে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সমীচীন নয়; কারণ এতে রাষ্ট্রের নিজস্ব নিরাপত্তার বিষয়টি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। বাংলাদেশ রাশিয়া এবং ইউক্রেন – দুই দেশের সাথেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখতে চায়। এছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তির ব্যবহার থেকে নিরস্ত্র থাকবে এবং পরিপূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য সচেষ্ট হবে। এ কারণে কোনো যুদ্ধ জোট অথবা বৃহৎ শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশ কখনো সরাসরি যুক্ত হয় না। দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।

জাতিসংঘের গৃহীত চারটি প্রস্তাবের মধ্যে বাংলাদেশ শুধুমাত্র একটিতে ভোট দিয়েছে আর বাকি তিনটিতেই ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। যুদ্ধ বন্ধে ও অবিলম্বে রুশ সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ যে প্রস্তাবটি পাস করেছে, প্রকৃতপক্ষে প্রস্তাবটির ভেতরে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান না জানিয়ে রাশিয়াকে দোষারোপ করার কারণে বাংলাদেশ উক্ত প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত থাকে; যা বাংলাদেশের কৌশলগত, কূটনৈতিক এবং নিরপেক্ষ অবস্থান। (তথ্য: বিডিনিউজ২৪.কম) দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ এ প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। জাতিসংঘের যে দ্বিতীয় প্রস্তাবটি আনা হয়, সেটিতে ইউক্রেনে মানবিক সঙ্কট নিরসনে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এ কারণে সেই প্রস্তাবের পক্ষে বাংলাদেশ ভোট দিয়েছে।

ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার কথা বলছে বাংলাদেশ সরকার। সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বানও জানানো হয়েছে সরকারি বিবৃতিতে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক অথবা তৃতীয় কোনো পক্ষের নিঃস্বার্থ সহায়তায় দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতা এবং একটি আশু সমাধানে আসা একান্ত প্রয়োজন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের পটভূমিতে ‘অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করা এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় যৌথ পদক্ষেপ প্রয়োজন’ বলে মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং এক দেশ অপর দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সমর্থন রেখে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। পশ্চিমা বিশ্ব অথবা তৃতীয় কোনো বৃহৎ পক্ষ থেকে যুদ্ধ বন্ধের পরিবর্তে যুদ্ধের উস্কানি দেওয়া কিংবা কোনো পক্ষ অবলম্বন করে স্বার্থ অন্বেষণ করুক, সেটিও আমরা চাই না। এতে কখনো যুদ্ধের অবসান হয় না, আরো দীর্ঘায়িত হয়। মানুষের জীবনে নেমে আসে আরো বিপর্যয়। যুদ্ধ মানবতার জন্য কখনো কোনো ধরনের কল্যাণ বয়ে আনেনি, ভবিষ্যতেও আনবে না। বৈশ্বিক উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বিশ্বকে এই যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ করার সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে। যুদ্ধ এড়িয়ে দু’পক্ষের বিরাজমান সমস্যাগুলো কূটনীতির মাধ্যমে সমাধান করাই বুদ্ধিমানদের কাজ। জাতিসংঘকে এ বিষয়ে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশ্বশান্তি ও মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সবাইকে এই যুদ্ধ অবসানের জন্য নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যুদ্ধ নয়, শান্তিতে বাঁচতে চাই, চাই মানবতার মুক্তি। কবি নজরুলের মতো বলতে চাই,

“গাহি সাম্যের গান

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।

নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,

সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।”